বিটকয়েন একটি ক্রিপ্টো কারেন্সি। ক্রিপ্টো কারেন্সি বা ক্রিপ্টোমুদ্রার ইতিহাস বেশি দুরের নয়। এক সময় মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য সরাসরি পণ্য আদান-প্রদান করত। সে সময়ে কোনো মুদ্রার প্রচলন ছিল না। কারো কাছে যদি এক ধরনের পণ্য থাকত তাহলে সে তার প্রয়োজনীয় পণ্য যার কাছে আছে তার থেকে সরাসরি সমপরিমানের বা সম-মূল্যের পণ্য দিয়ে আদান-প্রদান করতো।
সময়ের ব্যবধানে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে কেনা-বেচার সুবিধার্থে কড়ী বা এমন কিছুকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। এর পরে সোনা, রুপা, তামা সহ বিভিন্ন পদার্থের মুদ্রার প্রচলন হয়। এর পরে আসে কাগজের টাকা। এভাবে সময়ের ব্যবধানে আমরা আমাদের সম্পদ ব্যাংক এ রাখতে পারি। এমনকি অনলাইন ব্যাঙ্কিং এবং মোবাইল ব্যাঙ্কিং এর মত সুবিধার ফলে আমরা আমাদের সকল টাকা-পয়সা পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারি এবং তা অনলাইনেই আদান-প্রদান করতে পারি।
তবে এক দেশের কারেন্সি অন্য দেশে ব্যহারযোগ্য নয়। সকল দেশের কারেন্সি সে দেশের সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এক দেশের কারেন্সি অন্য দেশে পাঠাতে হলে সেখানে কিছু প্রসিডিউর মেনে পাঠাতে হয়। এর মাঝে সময় ব্যয় হয়, এক দেশের কারেন্সি থেকে অন্য দেশের কারেন্সিতে রুপান্তর করার জন্য কিছু অর্থ খরচ হয়। কিন্তু ক্রিপ্টো কারেন্সির বেলায় তা হয় না। সাধারনত এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশে পাঠাতে হলে কোনো ব্যাঙ্ক এর মাধ্যমে পাঠাতে হয়। অথবা কোন তৃতীয় পক্ষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। ক্রিপ্টো কারেন্সি গুলো এক জনের থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাতে কোন তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হয় না। প্রেরক সরাসরি প্রাপকের একাউন্টে পাঠাতে পারে। বর্তমানে বিটকয়েনের মত অনেক ক্রিপ্টো কারেন্সি প্রচলিত আছে। যেগুলোর ব্যবহার প্রায় একই রকম।
বিটকয়েনের ইতিহাস
বর্তমানে প্রচলিত মুদ্রার ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা সমাধানেই মুলত এই বিটকয়েনের আবিস্কার হয়। সর্বপ্রথম ১৮ই আগষ্ট ২০০৮ সালে https://bitcoin.org/ ডোমেইনটি রেজিস্টার করা হয়। এতে বোঝাই যায় বিটকয়েনের কার্যক্রম এর অনেক আগে থেকেই চলছিলো। সে বছরেই Satoshi Nakamoto এর নামে কেউ বা কারা বিটকয়েনে কার্যপ্রণালী Metzdowd.Org ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
এর পরে ২০০৯ সালের ৪ নভেম্বর Satoshi Nakamoto সোর্স ফোর্য এ বিটকয়েনের Source Code উন্মুক্ত করে।
এ মাস থেকেই বিটকয়েনের নেটওয়ার্কের প্রচার হতে থাকে এবং ৩ জানুয়ারি ২০০৯ Satoshi Nakamoto ব্লকচেইনের সর্বপ্রথম ব্লক মাইন করে। যা genesis block নামে পরিচিত।
এর পরে ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারি সর্বপ্রথম Satoshi Nakamoto এবং Hal Finney নামক এক ব্যক্তির মাঝে ১০ বিটকয়েনের ট্রানজেকশন হয়। Satoshi Nakamoto এই ১০ বিটকয়েন Hal Finney কে পাঠান।
তবে এখানে মজার বিষয় হলো বিটকয়েনের মূল হোতা হিসেবে Satoshi Nakamoto নামটি আমাদের সামনে আসলেও Satoshi Nakamoto কি একজন ব্যক্তির নাম, নাকি কোনো প্রতিষ্ঠান। কেই বা রয়েছে এর নেপথ্যে তা জানা যায়নি।
কোনো দেশের মুদ্রার উপর সে দেশের সরকারের নজরদারি থাকে এবং নিয়ন্ত্রন থাকে। কিন্তু বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি গুলোতে কোনো দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিটকয়েন শুধু এর মালিক বা ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোনো দেশ বা বর্ডার এর সীমাবদ্ধতা নয়। বিটকয়েন তৈরিতে ব্লকচেইন ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর ট্রানজেকশনে ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহার করা হয় যার কারণে এটি অনেক সুরক্ষিত। অর্থাৎ এর আদান-প্রদানে গরমিল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নাই। ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহারের কারণে এ সমস্ত কারেন্সিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বলা হয়।
আপনি বিটকয়েনের মালিক হতে চাইলে আপনাকে বিটকয়েন এর কোনো একটি ওয়ালেটে একাউন্ট থাকতে হবে। সেই ওয়ালেট টি আপনার ব্যক্তিগত ওয়ালেটের মতই। সেখানে আপনি যত ইচ্ছা বিটকয়েন রাখতে পারবেন। যে কোনো দেশে যে কোনো বিটকয়েন ওয়ালেটে পাঠাতে পারবেন। পাঠানোর প্রক্রিয়ায় কোনো দেশের সরকারের কর্তৃত্ব চলে না।
বিটকয়েন ট্রানজেকশন
বিটকয়েনের লেন-দেন এবং এর মাইনিং ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়ে থাকে। কোনো একটি একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে বিটকয়েন পাঠাতে হলে প্রথমে আপনাকে ট্রানজেকশনের জন্য রিকোয়েস্ট করতে হবে। এর পরে ব্লক এর অধিকাংশ মেম্বার আপনার ট্রানজেকশন এপ্রুভ করলে তার পরে আপনার ট্রানজেকশন ভ্যালিডেট হবে। এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, যেহেতু ট্রানজেকশনগুলো সবার সামনে উন্মুক্ত, তাই প্রাইভেসি কিভাবে রক্ষা হবে?
যেই আইডি দিয়ে ট্রানজেকশন এপ্রুভ করা হবে, সেই আইডিই একমাত্র আপনার পরিচয় বহন করে। কিন্তু এর নেপথ্যে কে এই আইডি র মালিক, তা জানা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রাইভেসি রক্ষা হবে।
বিটকয়েনের মূল্য
বিটকয়েনের পরে অনেক ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজারে আসে। এবং এর মূল্য কম-বেশি হয়। তবে এখন পর্যন্ত বিটকয়েনের বাজারমূল্যই সবচেয়ে বেশি। যখন বিটকয়েন আবিষ্কার করা হয়েছিল, তখন ২০০৯ থেকে ২০১০ এর ভেতরে, ১ বিটকয়েন এর মান (value) প্রায় কিছুই ছিল না।
তবে, ২০১০ সালের মার্চ মাসে ১ বিটকয়েনের দাম $0.003 এবং জুলাই মাসে $0.008-$-0.08 এর ভেতরে ছিলো।
২০১২ সালের পর প্রায় ২০১৩ সালের থেকে, বিটকয়েনের মান তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে (১২ ডিসেম্বর, ২০২২) ১ বিটকয়েনের এর মূল্য বাংলাদেশী টাকায় 1,761,085.42 টাকা। অথচ সর্বপ্রথম বিটকয়েন $0 থেকে $0.9 হয়েছিলো।
এখন ও এর দাম কমছে-বাড়ছে৷
সাপ্লাই-ডিমান্ড চেইন এর ও একটি ব্যাপার আছে এর দাম কম – বেশি হওয়ার পেছনে। তবে সব দেশের লোকাল কারেন্সিতে এর দাম সমান নয়। এক এক দেশের মুদ্রার মান অনুযায়ী এর দাম। তবে ইউএস ডলারকে এর স্ট্যান্ডার্ড মান ধরা হয়।
সুবিধা-অসুবিধা
বিটকয়েনের এত কিছু ভালো দিকের মধ্যে এর কিছু খারাপ দিক ও রয়েছে। যেহেতু এর আদান-প্রদানের কোনো তথ্য তৃতীয় পক্ষ জানতে পারে না এমনকি কোনো দেশের সরকার ও নজরদারি করতে পারে না। তাই বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপে এর ব্যবহার হয়ে থাকে অনেক সময়ই।
ক্রিপ্টো কারেন্সির সুবিধা:
- শুধু একটি মাত্র আইডি নম্বরই আপনার পরিচয় বহন করে, এর প্রকৃত ব্যবহারকারী কে তা জানা যায় না।
- যেকোনো স্থান থেকে ট্রানজেকশন করা যায়।
- ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে খুবই সিকিউর। ব্লকচেইন এর মূল সফটওয়্যারটি Open Source অর্থাৎ কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং ক্রিপ্টোগ্রাফাররা নেটওয়ার্কগুলির সমস্ত দিক পরীক্ষা করতে এবং তাদের সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
- ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের প্রতিটি ট্রানজেকশন সবার সামনে উন্মুক্ত হওয়ায় Manipulation বা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব।
- কোন দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকায় যে কোন স্থানে ব্যবহারযোগ্য, আপনি বিশ্বের যেখানেই থাকুন না কেন এটি লেনদেন করতে পারবেন।
ক্রিপ্টো কারেন্সির অসুবিধা:
- বিটকয়েন মাইনিং এবং এর প্রক্রিয়া ব্লকচেইন ব্যবহার করে করা হয় তাই প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, কারণ এটি একটি ডিজিটাল প্রক্রিয়া, যেখানে নোডগুলি অর্থাৎ কম্পিউটারগুলি হাজার হাজার লক্ষ গণনা করে real time ডেটাতে কাজ করে।
- ক্রিপ্টোকারেন্সির এর আদানপ্রদান এবং এর মাইনিংয়ের প্রক্রিয়া বেশ জটিল, যার কারণে সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে এটি বোঝা আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
- প্রতিটি ট্রানজেকশনে নোডগুলির পারস্পরিক সম্মতিতে প্রয়োজন হয়, যেখানে সরকারী সংস্থার কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জালিয়াতির সম্ভাবনা থেকেই যায় ।
বিটকয়েনের কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমনি কিছু অসুবিধাও লক্ষ করলাম আমরা। কোনো একটি প্রযুক্তি সমাজের জন্য কতটা কল্যাণকর হবে তা নির্ভর করে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর। তেমনি ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরী এ বিটকয়েন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। যদিও সুবিধার সাথে সাথে অসদুপায়ে ব্যবহার এবং খারাপ ভাবে ব্যবহারের পসিবিলিটি থেকেই যায়, যা প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে। তদুপরি বিটকয়েন আমাদের জন্য নতুন একটি দিগন্তের উন্মোচন করেছে তা অনস্বীকার্য।